ইসলাম প্রচারের জন্য ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের কারণে রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায়ই ভারতবর্ষে আসে সাহাবায়ে কেরামের কাফেলা। তাদের ইবাদত-বন্দেগির সুবিধার্থে তখনই ভারতবর্ষে মসজিদ ও ইবাদতখানা নির্মাণ করা হয়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত প্রথম মসজিদ হচ্ছে—ভারতের কেরালা রাজ্যের ত্রিসুর অঞ্চলের কুদুঙ্গালুর তালুক শহরের মিথালা নামক গ্রামে অবস্থিত চেরামান জামে মসজিদ।
মসজিদটির সম্মুখভাগে স্থাপিত শিলালিপির ভাষ্যানুযায়ী পঞ্চম হিজরি মোতাবেক ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে সাহাবি হজরত মালিক বিন দিনার (রা.) (মৃত্যু : ১২৭/১৩০ হিজরি) মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। স্থানীয় মুসলমানদের কাছে মসজিদটি ‘চেরামান জুমা মসজিদ’ নামে পরিচিত।
কেরালার সঙ্গে আরবদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ইসলামপূর্ব প্রাচীনকাল থেকে ছিল। ভারত মহাসাগর ও আরব উপসাগরের সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা কেরালায় আরবদের যাতায়াত ছিল বেশি।
প্রাচীন ভারতীয় পাণ্ডুলিপিতে আছে, আরব বণিকদের কাছে ইসলামের অনুপম সম্প্রীতি-ভালোবাসা ও সাম্য দেখে কেরালার রাজা চেরামান পেরুমল ভীষণ আকৃষ্ট ও প্রীত হন। ফলে তিনি আরব মুসলিম বণিকদের সঙ্গে মক্কা নগরীতে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি তাজউদ্দিন নাম ধারণ করেন।
বিখ্যাত হাদিসগ্রন্থ ‘মুসতাদরাকে হাকিম’-এ আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, ‘রাসূল (সা.)-এর কাছে ভারতবর্ষের রাজা আদাভর্তি একটি কলসি উপহার পাঠান। রাসূল (সা.) প্রত্যেককে এক টুকরা করে খেতে দেন। আমাকেও এক টুকরা দিয়েছিলেন।’
লন্ডনভিত্তিক ভারতীয় এনসাইক্লোপিডিয়ার বরাতে ব্রিটিশ ও ভারতীয় ইতিহাসবেত্তারা দাবি করেন, হাদিসে উল্লিখিত ভারতীয় রাজা হলেন কেরালার রাজা চেরামান পেরুমল।
ঐতিহাসিক একটি তথ্য ও কেরালার মুসলমানদের কাছে প্রজন্মপরম্পরায় জনশ্রুতিও রয়েছে যে, মতে রাজা চেরামান পেরুমল ১৭ রজব ৬১৭ খ্রিস্টাব্দে মহানবী (সা.)-এর আঙুলের ইশারায় চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হতে দেখেন। তিনি তার রাজ্যের ধর্মীয় পুরোহিতদের কাছে এ অদ্ভুত রহস্য জানতে চান।
কিন্তু রাজ্যের ধর্মীয় যাজকরা তাকে কোনো সদুত্তর দিতে সক্ষম হয়নি। পরে আরব মুসলিম বণিকদের কাছে ঘটনার সত্যতা ও রহস্য জানতে পারেন তিনি। ফলে উত্তরসূরিদের কাছে রাজ্যের দায়িত্বভার দিয়ে আরব বণিকদের সঙ্গে তিনি মক্কা গমন করন। মক্কা গিয়ে তিনি রাসূল (সা.)-এর কাছে ইসলাম গ্রহণ করেন।
ইসলাম গ্রহণের পর ১৪ জনের একটি কাফেলা নিয়ে চেরামান পেরুমল কেরালার উদ্দেশে রওনা হন। সাহাবি মালিক ইবনে দিনার (রা.) ও হাবিব ইবনে মালিক (রা.)-ও তার সে কাফেলায় ছিলেন।
কিন্তু ওমানের ঝিফার (সালালাহ্) অঞ্চলে পৌঁছার পর তিনি ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। মৃত্যু অত্যাসন্ন বুঝে মালিক ইবনে দিনার মারফত তাঁর আত্মীয়স্বজনদের কাছে একটি পত্র লিখে অসিয়ত করেন, তারা যেন যথাসম্ভব কাফেলাটিকে সাহায্য-সহযোগিতা করে।
কেরালার শাসকরা অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে কাফেলাটি বরণ করে। উপরন্তু ইসলাম প্রচারের সুবিধার্থে মসজিদ নির্মাণেরও অনুমতি দেয়। তাদের অনুমতি পেয়ে কুদুঙ্গালুর তালুকে নির্মিত ‘চেরামান মসজিদ’টিই হচ্ছে ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত প্রথম মসজিদ। মালিক ইবনে দিনার ছিলেন এই মসজিদের প্রথম ইমাম ও তত্ত্বাবধায়ক। তাঁর পরে হজরত হাবিব ইবনে মালিক ইমাম তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
মোট কয়েক দফা মসজিদটির সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ করা হয়। ক্রমান্বয়ে মুসল্লি বৃদ্ধির ফলে ১৯৭৪, ১৯৯৪ ও ২০০১ সালে মসজিদের সামনের অংশ ভেঙে আয়তন সম্প্রসারিত করা হয়। অবশ্য প্রাচীন মসজিদের অভ্যন্তরীণ অংশ, মিহরাব ও মিনার এখনো আগের মতো অক্ষত রয়েছে।
মসজিদের বাহিরের অংশ কংক্রিট দিয়ে তৈরি হয়। অজু করার জন্য নির্মিত তখনকার পুকুর এখনো রয়েছে। মসজিদের পাশঘেঁষা খালি জায়গায় দুইটি কবর রয়েছে। ধারণা করা হয়, একটি হাবিব ইবনে মালিকের, অন্যটি তাঁর স্ত্রী মুহতারামা হুমায়রার।